জাম্বুরি পার্ক উদ্বোধনকালে পূর্তমন্ত্রীর পরামর্শ
নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্রগ্রাম থেকে ::
আনুষ্ঠানিকভাবে দরজা খুলল আগ্রাবাদস্থ জাম্বুরী পার্কের। উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য। গতকাল উদ্বোধনের পরেই পার্কটি দর্শনার্থীদের ভিড়ে মুখরিত হয়ে ওঠে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি বলেছেন, চট্টগ্রামে আরও পার্ক নির্মিত হবে। এ পার্কটির পাশেই ফুটবল, ক্রিকেট ও হকি খেলার তিনটি মাঠ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
মোশাররফ হোসেন বলেন, আমরা চট্টগ্রামবাসীকে এ পার্কটি করে দিয়েছি। কিন্তু এ পার্কটির পরিস্কার–পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব আপনাদের। রাজধানী ঢাকায় রমনা পার্কের অতীতের তিক্ততার কথা তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, আগে রমনা পার্কটি যাদের দায়িত্বে ছিল। সেটা রমনা পার্ক ছিল না। সেখানে সকাল থেকেই কেউ কাচ্চি খেত, কেই বিরানী খেত, আবার কেউ বাদাম খেত। সেখানে অপরিস্কার–অপরিচ্ছন্নের পাশাপাশি বছরে ৩০টি মেলা হত। আমি এগুলো সব বন্ধ করে দিয়েছি। রমনা পার্কে প্রকাশ্যে ধুমপানের জন্য আমি নিজেই আড়াইশো জনকে কানে ধরে উঠ–বস করিয়েছি। এখন রমনা পার্ক ধুমপানমুক্ত এলাকা।
চট্টগ্রামের জাম্বুরি পার্কটিও ধুমপানমুক্ত এলাকা হবে বলে জানান তিনি। মন্ত্রী বলেন, এখানে আপনারা হাটবেন, আর নিঃশ্বাস নেবেন। স্বাস্থ্যকর পরিবেশে হাটবেন। এখানে এটা–সেটা খাবেন না। আপনারা পার্কে প্রেমিকাকে নিয়ে আসবেন। কিন্তু বাদাম খাবেন না। বাদাম খেলে পার্ক নষ্ট হয়ে যাবে। আমার বাচ্চারা যারা পানি ভালোবাসে। এ পার্কে কিছু পানি ধরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু এখানে কোন গোসল করা যাবে না। এ পার্ক আমাদের। চট্টগ্রামের। এখানে অনেক গাছ লাগানো হয়েছে, এগুলোকে বাড়তে দিতে হবে। পার্কে লাগানো গাছগুলো বড় হলে, তখন দেখবেন এটা রমনা পার্কের চেয়েও সুন্দর হয়ে গেছে।
চট্টগ্রামে জাম্বুরী পার্কটির পাশেই তিনটি খেলার মাঠ নির্মানের কথা জানিয়ে আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, পার্কের পাশেই কিছু জায়গা নিয়ে মামলা চলছে। এ মামলা শেষ হলেই দু’দিনের মধ্যেই জায়গাটা পরিস্কার হয়ে যাবে। এ পরিস্কার হবে আপনাদের জন্য। এখানে তিনটি খেলার মাঠ নির্মাণ করা হবে। এরমধ্যে একটি ফুটবলের, একটি ক্রিকেটের এবং একটি হকি খেলার মাঠ। মাঠগুলোতে লাইট লাগানোর ব্যবস্থা থাকবে। এখানে আপনারা রাতেও খেলাধুলা করতে পারবেন। আপনাদের কাছ থেকে একটা টাকাও নেব না। সব টাকা দেবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে চট্টগ্রামে আরও পার্ক নির্মাণের পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণের কথা জানিয়েছেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে বায়েজিদে ৩ একরের উপরে একটি জায়গায় পার্ক নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। অক্টোবরের মধ্যেই পার্কটির কাজ শেষ হবে আশা করছি। এছাড়া ডিসি হিলকে ঘিরে সৌন্দর্যবর্ধন কাজ নির্বাচনের পরে করার কথা জানিয়েছেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী।
মনসুরাবাদে ২০তলার ভবন নির্মানের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীরা যারা চট্টগ্রামে আসবেন তাদের জন্য শতভাগ আবাসনের ব্যবস্থা আমরা করব। নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটিতে ৪৩টি বাড়ি মামলা করে আত্মসাৎ করতে চেয়েছিল জানিয়ে গণপূর্ত মন্ত্রী তিনি বলেন, এটা সরকারি সম্পত্তি। মামলা করে তারা রায়ও পেয়েছিল। এবার সেই রায় পাল্টে সরকারের পক্ষে আমরা রায় পেয়েছি। আমি প্রধানমন্ত্রীকে এ সুখবর জানিয়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছেন, খুব ভাল করেছেন। আপনি যত দ্রুত সম্ভব,ডিপিপি নিয়ে আসেন। এখানে বহুতল ভবন করব সরকারি কর্মচারীদের জন্য। বর্তমানে ডিপিপি তৈরির পাশাপাশি ইতিমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে চলে গেছে। এটা আমার ইচ্ছা নয়, এটা প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা। এ বিষয় নিয়ে যদি কারো কোন অসুবিধা হয় তাহলে আমার জন্য কিছু যায় আসে না বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী।
তিনি বলেন, কেউ ব্যক্তিগতভাবে এ সম্পত্তিকে কুক্ষিগত করুক এটা আমরা কেউ চায় না। এটা পাকিস্তান ফেলে গেছে। এটা পরিত্যাক্ত সম্পত্তি। এটা কার সম্পত্তি? এটা সরকারি সম্পত্তি। যুদ্ধ করেছি আমরা, রক্ত দিয়েছি আমরা, পাকিস্তান চলে গেছে। এখন এ সম্পত্তি কার হবে? এ সম্পত্তি হবে সরকারি। এটা কি কো অপারেটিভ সোসাইটির হবে? হবে না। এখানেও পার্ক করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী।
পাকিস্তানে ইমরান খানের সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রসঙ্গ নিয়ে একটি আলোচনার কথা তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, গত দশ বছরে আমরা অনেক এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা আরও এগিয়ে যাব। আপনারা দোয়া করবেন, নৌকার বিজয়ের জন্য। ইনশা আল্লাহ নৌকার বিজয় নিশ্চিত হবে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দ্যেশ্যে মন্ত্রী বলেন, ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। আশা করছি সকল দলের অংশগ্রহণে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশনও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে এ নির্বাচন পরিচালনা করবেন বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী।
এর আগে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী তার বক্তব্যের শুরুতেই নিজেসহ চট্টগ্রামের প্রয়াত রাজনীতিবিদরা চট্টগ্রামের উন্নয়ন নিয়ে অনেক স্বপ্নের কথা স্মরণ করে বলেন, আমরা সবাই চট্টগ্রামের জন্য অনেক স্বপ্ন দেখেছি। তারা আজ প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু আমি জীবিত আছি। আমাকে হয়ত জীবিত রাখা হয়েছে এ উন্নয়ন কাজগুলো করার জন্য। চট্টগ্রাম–১১ আসনের সাংসদ এম আব্দুল লতিফ জাম্বুরী পার্কটিকে শেখ হাসিনা পার্ক হিসেবে নামের প্রস্তুাব করেন।
চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম বলেন, ঢাকায় পার্ক থাকলেও চট্টগ্রামে কোন পার্ক নেই। চট্টগ্রামবাসী বহুকাল ধরেই এ পার্কের অভাব বোধ করছিল। এরই অংশ হিসেবে জাম্বুরী পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদিচ্ছায় এসব উন্নয়ন হচ্ছে। গত ১০ বছরে চট্টগ্রামে নজিরবিহীন উন্নয়ন হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, জননেত্রী শেখ হাসিনার সুশাসনের কারণে আজ আকাশে স্যাটেলাইট উড়ছে।
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, ফ্লাইওভার, মেরিন ড্রাইভ, কর্ণফুলী টানেলসহ চট্টগ্রামে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মকান্ড চলছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম চট্টগ্রামে নানা উন্নয়ন কাজের কথা তুলে ধরে বলেন, বিভিন্ন পুরনো কলোনীতে আধুনিক সুবিধা সম্বলিত ভবন নির্মাণের ব্যাপারে মন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশনা আমাদের দিয়েছেন।
এর আগে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন, গণপূর্ত অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, মশার প্রজনন ক্ষেত্র, মাদক আস্তানার কেন্দ্র ছিল এ জাম্বুরী মাঠটি। আমরা এটাকে কনভার্ট করে আধুনিক সুবিধা সংবলিত একটি দৃষ্টিনন্দন পার্ক গড়ে তুলেছি। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা এ পার্কটি চট্টগ্রামবাসীকে উপহার দিতে পেরেছি।
এদিকে উদ্বোধনী দিনেই বিকেলে দর্শনার্থীদের যেন একটি মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। পার্কটির আনাচে–কানাচে শতশত দর্শনার্থীদের ভিড় ছিল। শিশু থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধদের উপস্থিতি পার্কটিতে দেখা যায়। সন্ধ্যা হলেই জলাধারের বাহারি রঙের আলোকচ্ছট্টায় পুরো পার্ক জুড়ে একটি দৃষ্টিনন্দন চেহারায় রূপ পেতে দেখা যায়। এতে দর্শনার্থীরা আনন্দ উল্লাসের পাশাপাশি মনোরম দৃশ্যগুলো উপভোগ করেন। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে অনুমোদন পাওয়া ৮ দশমিক ৫৫ একর আয়তনের জাম্বুরী পার্ক প্রকল্পটি নির্মাণের ব্যয় হয় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেন। পার্কটির অবকাঠামোর মধ্যে রয়েছে ২টি টয়লেট ব্লক, ১টি গণপূর্ত রক্ষণাবেক্ষণ ব্লক এবং ১টি গণপূর্ত বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্র ব্লক, ৬টি সুসজ্জিত গেট, ১টি পাম্প হাউস, ১টি গণপূর্ত বৈদ্যুতিক রক্ষণাবেক্ষণ ব্লক, সিটিং বেঞ্চ,জলাধার ও ফোয়ারা, ২ হাজার ৪’শ ফুট দৃষ্টিনন্দন সীমানা প্রাচীর, অভ্যন্তরীণ ও বহি:পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, প্রায় ৮ হাজার ফুট সুদীর্ঘ ওয়াকওয়ে বা কম্পাউন্ড রোড, অভ্যন্তরীণ মাস্টার ড্রেন, বৃষ্টি ও জোয়ারের পানি থেকে পার্কটির সুরক্ষার জন্য পার্ক এলাকাটি ৩ ফুট উঁচুকরণ, ৫০ হাজার বর্গফুটের নকশা সমৃদ্ধ জলাধার, জলবেষ্টিত ঝরণা, আধুনিক শৌচাগার, ২৪ ঘন্টা নিরাপত্তা সম্বলিত ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা, জলাধারের কিনারায় বসার উন্মুক্ত গ্যালারি এবং মনোরম ল্যান্ডস্ক্যাপিং।
প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শারীরিক ব্যায়ামের লক্ষ্যে প্রশস্ত ও দীর্ঘ জগিং ট্রাক স্থাপন, বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের মানসিক প্রশান্তির লক্ষ্যে উন্মুক্ত উদ্যান এবং নির্মল বাতাসের জন্য উদ্যান ও জলাধার তৈরিই এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। পার্কের প্রবেশের নিয়মাবলীর ব্যাপারে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সকাল সাড়ে ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত পার্কটি খোলা থাকবে। ধুমপান সম্পূর্ণ মুক্তের পাশাপাশি পার্কটিতে খেলাধুলা করা যাবে না। এছাড়া ফেরিওয়ালা, চা–বাদাম বিক্রয় বা কোন বাণিজ্যিক কার্যক্রম পার্কে পরিচালনা করা যাবে না বলে নিয়মাবলীতে জানানো হয়েছে।
পাঠকের মতামত: